মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার এক গ্রাম। ছোট্ট মেয়েটা পড়ে ছিল অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মত। তাই তার নাম ছিল ' চিন্ডি'। মানে ছেঁড়া কাপড়। বাড়ীতে একটা শ্লেট কেনার পয়সাও ছিল না। ভারাডি গাছের পাতা ছিঁড়ে তাতেই লিখত সে। পড়াশোনা করার ইচ্ছে। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাখাল বাবার কানে কানে বলে স্বপ্নের কথা। বাবা চাইলেও মা রুখে দাঁড়ালো। গরীবের ঘরের মেয়ের অত শখ কিসের! তাই চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া চলাকালীন কুড়ি বছরের বড় একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেল মেয়ের। বয়স তখন মাত্র ১০।
এখানেই জীবন থেঁতলে যাওয়ার কথা। কিন্তু মেয়েটি স্বপ্ন দেখা ছাড়লো না। নবরগাঁও জঙ্গলের গরীব গোবরকুড়ানী নারীদের ওপর বন দপ্তর আর জমিমালিকেরা অত্যাচার করত। তাদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করল সে। এই লড়াইয়ে কেউ তার পাশে ছিল না, বরং তার জীবনে আরও অন্ধকার নেমে এলো। মেয়েটি তখন গর্ভবতী। গ্রামে তার নামে বদনাম রটালো এক জমি মালিক। অবৈধ সম্পর্কে জড়িত আছে বলে সবাই একঘরে করে দিল তাকে। এমনকি তার স্বামীও মারধোর করে তাড়িয়ে দিল। পরিত্যক্ত অবস্থায় ভরা পেটে মেয়েটি এক গোয়ালে আশ্রয় নিল। কেউ নেই সাথে। অসহায় মেয়েটিকে দেখে আকাশও কেঁদে উঠলো। একা একা মেয়েটি জন্ম দিলো এক কন্যাসন্তানের। অ্যাম্বিলিকাল কর্ড কাটলো পাথর দিয়ে ঘষে ঘষে। হায় রে ভারতবর্ষ। শুনতে পারছেন বন্ধুরা, সেই মেয়েটির কান্না? না, সে কাঁদেনি। কারণ কাঁদার সময় ছিল না। বাচ্চাটিকে বাঁচাতে হবে।
মেয়েটি তার বাবার বাড়িতে যায় আশ্রয় চাইতে। সেখানে তার জন্মদাত্রী মা তাকে বাড়িতে ঢুকতে বারণ করেন - 'কার পাপ নিয়ে এসেছিস সাথে করে? ' আত্মহত্যা করার উপায় নেই। কোলে সন্তান নিয়ে মেয়েটি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ভিক্ষা করে গান গেয়ে একটু খাবারের জন্য। রাস্তায়, ফুটপাথে, রেল স্টেশনে এমনকি কবরস্থানেও রাতের পর রাত কাটে।
এই পর্যন্ত পড়ে যারা ভাবছেন, আমি কোন সিনেমার প্লট লিখছি, তারা দয়া করে পরের টুকু পড়ুন। জীবন অনেকেরই পরীক্ষা নেয়। অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে জীবন থেকে মুক্তো কুড়োতে পারেন কজন? সিন্ধুতাই সাপকাল পেরেছিলেন। ঘর হারানোর কষ্ট তিনি জানতেন। তাই বেছে নিলেন ঘরহারা অনাথ শিশুদের। প্রথম লড়াই মহারাষ্টের অমরাবতী জেলার চিকলদাড়ায়। এক ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য ৮৪ টি আদিবাসী গ্রাম খালি করা হচ্ছিল। রুখে দাঁড়ালেন সিন্ধুতাই। তাঁর জন্যই পুনর্বাসিত হল গ্রামের মানুষেরা।
যাদের মা নেই তাদের মা হলেন সিন্ধুতাই। যে মানুষটা নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ভিক্ষা করেন, তিনি দত্তক নেওয়া শুরু করলেন অনাথ অসহায় শিশুদের। ভিক্ষা করে ব্যবস্থা করলেন তাঁদের শিক্ষার। এখনো পর্যন্ত ১৪০০ অনাথ শিশুকে মানুষ করেছেন তিনি। সেই শিশুদের কেউ ডাক্তার হয়েছে, কেউ উকিল হয়েছে। কিন্তু মানুষ হওয়ার মন্ত্র পেয়েছে সবাই। সিন্ধুতাই এর কন্যা মমতা এবং তার এই পুত্র কন্যারা আজকে নিজেদের অনাথ আশ্রম চালাচ্ছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় ৩০০ টি পুরষ্কার পাওয়া ৭০ বছরের সিন্ধুতাইকে সবাই আদর করে 'মাই' বলে ডাকে। স্থানীয় ভাষায় মা। কারণ সিন্ধুতাই বিশ্বাস করেন যে একজন বঞ্চিত শিশু একটি বঞ্চিত দেশের জন্ম দেয়। স্যালুট সিন্ধুতাই! লড়াই অনেকেই করেন। আপনি লড়াইটা সংক্রামিত করেছেন।
যারা ভাবেন জীবন শেষ হয়ে গেছে, আত্মহত্যা করা ছাড়া আর উপায় নেই, তারা একবার 'মা' য়ের দিকে তাকান। আপনি বলতে বাধ্য হবেন, জীবন খুব সুন্দর!
Friday, 25 May 2018
মা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
একদা কোন এক সময়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাধ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কবি সামসুর রহমান বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন । আড্ডা দেওয়ার এক পর্...
No comments:
Post a Comment