Tuesday, 13 July 2021

টিভি সিরিয়াল

বেশ কয়েকদিন আগের কথা, এক পরিচিতের  বাড়িতে গিয়েছি মায়ের সাথে। সন্ধ্যা সাতটা, টিভিতে তখন যথারীতি পাড়া কাঁপানো সিরিয়াল "শ্রীময়ী" চলছে। কাহিনীটা সবাই জানেন। সিরিয়ালে শ্রীময়ী একজন মধ্যবয়সী মহিলা,বড়বড় তিন ছেলেমেয়ের মা। স্বামী এই বুড়োবয়সে ডিভোর্স দিয়ে অফিসের কলিগ জুনকে বিয়ে করেছে। এইদিকে শ্রীময়ীর পুরোনো প্রেমিক আর চরম হ্যান্ডসাম সাথে বড়লোক রোহিত সেন রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানে বিপদে পড়বে আমাকে স্মরণ করিবে,আমি ছুটিয়া জুটিয়া যাইবো টাইপের মহাপুরুষ হয়ে শ্রীময়ীর জীবনে আসে। 
    যাইহোক, তো আমি আর মা যথারীতি বসে আছি সেই আত্মীয়ার বাড়ি।কিন্তু ওনার কথা বলার সময় নেই, যাষ্ট হাঁ করে গিলছেন সিরিয়াল। ব্যাপারটা এই, "তোমরা এই টাইমে যখন এসেছো তখন বসতে হবে বাপু। আগে শ্রীময়ী তারপর অন্য কিছু। বাকি দুনিয়া যায় ভার মেঁ। "
    হঠাৎ চিৎকার " যা যা চলে যা, চলে যা। ওরা তোকে কিছুই দেবেনা। চলে যা ওর সাথে, নিজের মতো করে বাঁচ। আমরা তো আর পারলামনা। "
   মা ফ্যালফ্যাল করে মহিলার দিকে তাকিয়ে। পিলে চমকে উঠেছে আমার তখন, কোথায় যাবো? কেন যাব? কার সাথে যাব? নিজের মতো বাঁচবো শুনলে মাবাবা দূর করে দেবে বাড়ি থেকে ভেবে ভেবে আমি তখন আকুল যখন মহিলা টিভিতে বিজ্ঞাপনের বদন্যতায় অমায়িক স্বরে জানালেন " শ্রীময়ীকে বলছিলাম। রোহিত সেনের সাথে নতুন করে সংসার করো। কেন সমাজের কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেবে? "
   মায়ের রিয়্যাকশন জানিনা। আমি তো বস পারলে মহিলাকে জড়িয়ে ধরি, কিন্তু খারাপ দেখায়। উফ্ উফ্  কি উচ্চমানসিকতা! যদি শ্রীময়ী দেখে এমন সমাজের উন্নতি হয় তো আমি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন রাখতেও রাজি যাতে টিভিতে ২৪ঘন্টা শ্রীময়ী চলে দেশ ও দশের উন্নতির জন্য। 
     কিন্তু, কিন্তু। কাহানী মেঁ টুইস্ট আসলো কয়েকমাস পরে।এইবার তিনি এসেছেন আমাদের বাড়ি, আমি তো উনাকে নিজের রোল মডেল ভেবেই নিয়েছি ততদিনে। একথা সে কথায় হঠাৎ শুনি বলছেন "জানো বৌদি আমাদের পাশের বাড়ির অল্পবয়সী ডিভোর্সী মেয়েটার কথা বলেছিলাম না? ছোটো একটা বাচ্চা আছে যার? কি বলবো রোজ বাড়িতে একটা ছেলে আসে, বলে দু সম্পর্কের দাদা। দাদা না ছাই! ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি চরিত্র দেখেছো? এমন মেয়ের স্বামী টিকবে কি করে বলো? "
      আমার কথা আর কিচ্ছু কানে যাচ্ছেনা। মানে? এই তো কদিন আগে শ্রীময়ীকে মুভ অন করতে বলছিলো, যেই নিজের পরিচিতের মধ্যে ঘটলো অমনি ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি?how??!!! 
    ঐদিন একটা কথা বুঝেছিলাম। মানুষ সিনেমা সিরিয়াল দেখে যে ঘটনায় বাহবা দেয়? ঠিক সেই ঘটনাটাই যদি ঘটে বাস্তবে? মানতে পারেনা। 
    আচ্ছা আরেকটা বিখ্যাত সিরিয়াল হলো খড়কুটো।কাহিনী কিছুই না, বড়লোকের বিশ্বন্যাকা( যে নাকি বায়োলজিক্যালি কি করে মানুষ প্রেগন্যান্ট হয় তাও জানেনা। ভাবে মানুষ গাছে হয়।)বিগড়ে যাওয়া ফেল করা এক মেয়ের বিয়ে হয় সায়েন্টিস্ট এক মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের সাথে। সেই বাড়ির লোকের ওদের ঘরে আড়ি পাতা ছাড়া কোনো কাজকর্ম নেই, আর ছোটো পোশাক গায়ে শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা আলফাল  কথা বলে বেড়ায়।আর শ্বশুরবাড়ির লোক তাকে মাথায় তুলে নাচে। এই সিরিয়ালের ন্যাকা নায়িকা মানে গুনগুনকে দেখে আমার বাড়ির লোক অবদি পাগল। আমি ভাবি অন্য কথা, আচ্ছা ধরুন আপনি মধ্যবিত্ত মফস্বলের মানুষ। ছেলের বৌ হটপ্যান্ট পরে বাড়িতে ঘোর,আপনি এতটাই মুক্তমনা তো যে মেনে নেবেন? আর বাড়ির বৌ এর কোনো দোষ না দেখে মাথায় তোলা?? এও হয়???!!!  আমার এক পরিচিত কাকিমা  শুনেছি এই সিরিয়াল না দেখলে অন্নস্পর্শ করেননা। তাঁরই আবার তাঁর পুত্রবধূর সাথে চরম অশান্তি। কারণ? কারণ একটাই বৌ টি নাকি কাজ করেনা। ইশারা কাফি হেঁ  মেরে দোস্ত। 
    বহু মণিমুক্ত ছড়িয়ে আছে, যা দেখে মানুষ হুটহাট মুক্তমনা হয়ে যাচ্ছে। যমুনাঢাকি না কি যেন! মেয়েটি সারাদিন চরম মেকাপ করে ঢাকা বাজায়।গঙ্গারাম সিরিয়ালে ছেলেটি ধুতিপাঞ্জাবি  গায়ে সরল মন নিয়ে রূপম ইসলামের গান গায় আর বৌ এর হাতে মার খায়। 
     আমি ভাবি অন্যকথা, আমার বাড়িতে খেলাঘর নামক এক দুনিয়া বদলে দেওয়া সিরিয়াল চলে।গুন্ডা নায়ক হুট করে একদিন বিলেত ফেরত এক মামণিকে  রাস্তায় সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে আবার বস্তিতে থাকতেও চলে এসেছে, একফোঁটা ইংরেজি ওয়ার্ড না বলে। আর সবচাইতে কেলেঙ্কারির কথা হলো গুন্ডা নায়ক নাকি হেব্বি পড়াশুনায় ছিলো। বুকে আঘাত পেয়ে গুন্ডা হয়েছে। বৌদি সিরিয়াল দেখে বলে "দেখ,কি আঘাত পেলো ছেলেটা।আহা "
    সিঁদুর পরানো ছাড়ুন।আমি ভাবছি অন্য কথা, স্ট্যাটাসে একটু কম হলে মানতে পারেননা। এইদিকে আপনার মেয়ে যদি পাকা বাড়িতে কোনও ভালো ছেলেকেও বিয়ে করে চলে যায়, জীবনে মুখ দেখবেন? 
     টিভি সিরিয়াল, সিনেমায় যে চরিত্রগুলোকে আমরা রোল মডেল ভাবি? অ্যাডমায়ার করি?ভালোবাসি? আসল কথা তো এই যে সেই চরিত্র বাস্তব হয়ে আমাদের চারপাশে জীবন্ত হয়ে উঠলে মেনে নিতে পারিনা। সেলুলয়েডের দুনিয়ায় যতটাই  মুক্তমনা, ততটাই একটা অন্ধকূপ মন বাস্তবটাকে মানতে শেখায়নি। আসলে আমাদের সবার মধ্যে দ্বৈতসত্ত্বা  বাস করে। আমরা কল্পনার জগতের মতো যদি বাস্তবেও এতটাই বুঝদার হতাম কত সম্পর্ক হয়তো আজও বেঁচে যেতো, কত মানুষ হয়তো হারিয়ে যেতোনা।টিভি সিরিয়ালকে দোষ দিই আমরা? 
 মাল্টিপ্লেক্সে  প্রাক্তন সিনেমাটা দেখেছিলাম যাদের সাথে তারা তখন সম্পর্কে ছিলো। মনে আছে হলে বসেই বান্ধবীটি নিচু স্বরে বললো "ইগোটা সব শেষ করে দেয় বুঝলি? কাউকে তো এগোতে হবে। নইলে সম্পর্ক টিকবে কি করে? "
     ওদের সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে একবছর হলো।কম্প্রোমাইজ করা হেরে যাওয়া নয় যাওয়া এই বিখ্যাত ডায়লগ নিজের ছবির ক্যাপশানে রেখেও, কেউ সেদিন একফোঁটা কম্প্রোমাইজ করেনি।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts