Thursday 30 September 2021

পুলিশের কবলে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়

১২ই সেপ্টেম্বর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের জন্মদিন। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মারা যান বিভূতিভূষণ। মৃত্যুর তিন বছর আগে একমাত্র ছেলে তারাদাস বন্দোপাধ্যায়(১৯৪৭-২০১০) জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা থেকে পাওয়া।

 তারাদাস বাবুর বয়েস তখন অল্প, বছর বাইশ তেইশ হবে। পাড়ার একজন দাদা স্থানীয় লোক অবসরপ্রাপ্ত ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষালের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন শুনে তারাদাসবাবুও চললেন তার সাথে। বাঙালির শার্লক হোমস এই পঞ্চানন ঘোষাল(১৯০৭-১৯৯০) অপরাধ বিজ্ঞান সাহিত্যের জনক। ক্রিমিনাল সাইকোলজিতে ডক্টরেটধারী প্রথম ভারতীয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নির্দেশেই ক্রাইম উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। তারাদাস বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর মুগ্ধ পাঠক। সুতরাং পাড়ার দাদার সাথে পঞ্চানন ঘোষালের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। গেলেন তাঁর কাছে এবং সঙ্গের দাদা পরিচয় করিয়ে দিলেন...বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে, শুনে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন পঞ্চাননবাবু। তারপর বললেন , "তোমার বাবাকে একবার পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল,জানো ?"।

তারাদাসবাবু বলে উঠলেন , "অসম্ভব। কখনো হতে পারে না। আমি সকলের মুখ থেকে শুনে বা পড়ে যা জেনেছি তাতে কখনো তা হতে পারে না। আমার বাবা কোনোদিন সেরকম ছিলেন না"। 
--"সেসব তোমার জানতে পারার কথা নয়, তাই জানতে পারনি । জোড়াবাগান থানায় গিয়ে খোঁজ করলে পেতে পারো। অবশ্য অত পুরোনো রেকর্ড আছে কি না কে জানে। আসল কথাটা আগে শোনো, সন্ধ্যার মুখে বাইরের কাজ টাজ সব সেরে থানায় ফিরেছেন বড় বাবু। থানার কাজকর্মের খোঁজ নেওয়া চলছে তখন। হাজত-বাবু হাজতে যারা ছিল তাদের বের করে এনে বড় বাবুর সামনে হাজির করল। বড় বাবু সব শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে রাখা হবে , কাকে ছাড়া হবে। যাদের বের করা হল তাদের মধ্যে ধুতি শার্ট পরা একজন ভদ্রলোককে দেখে বড় বাবু জিজ্ঞেস করলেন, "আরে এ তো ভদ্রলোক দেখছি , এ আবার কী করল"। 

হাজত বাবু বলল,"স্যার , উনি ঐখানে থানার দেওয়ালের খাঁজের মধ্যে পেচ্ছাপ
করছিলেন"।
 
"অ্যাঁ, থানার দেওয়ালে পেচ্ছাপ ? দেখে তো মনে হচ্ছে শিক্ষিত , পোশাকে আসাকে তো বেশ ভদ্দরলোক, ভদ্দরলোক লাগছে, খোলা জায়গায় এসব করতে নেই জানেন না ?"

--- "আর কোনোদিন হবে না। বিশ্বাস করুন, না পেরে বাধ্য হয়ে করে ফেলেছি। খুব জোর চেপেছিল, কোথাও কোনো টয়লেট খুঁজে পাই নি। আর পারছিলাম না, কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যেত। তাই একটু আড়াল দেখতে পেয়ে এখানে করে ফেলেছি। এটা যে থানা বুঝতে পারিনি ।"

--- "কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যেত বলে অন্যের বাড়ির দেওয়ালে পেচ্ছাপ করবেন ? থানার কথা নাহয় বাদই দিলাম । কী করেন ?"

--- "আজ্ঞে আর হবে না । আমি শিক্ষকতা করি ।"

--- "শিক্ষকতা করেন ? কোন স্কুল ?"

--- "খিলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল।" ধর্মতলাস্থ স্কুলটির তখন বেশ নাম ডাক ছিল।

--- "ওরে বাবা, অমুক স্কুল ? স্কুলটা কোথায় জানেন ?"

--- "বিশ্বাস না হলে ফোন করে দেখতে পারেন। আমার কাছে ফোন নাম্বার আছে দিতে পারি"।

ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করে দেখলেন বড় বাবু। কথা সত্যি। এবার আরো ঝেঁঝেঁ উঠলেন। "তাহলে তো সোনায় সোহাগা , মাস্টারমশাই হয়ে এসব করছেন, ছাত্ররা কী শিখবে ?"।

--- "বলছি তো ভুল হয়ে গেছে। আগে কখনও হয়নি। অবস্থার ফেরে হয়েছে আর কখনো হবে না"।

বড়বাবুর চোখ মুখ দেখে কোনো আশা পাচ্ছিলেন না ভদ্রলোক। ভাবছিলেন হয়ত আবার কোন কেস লাগিয়ে কোর্টে পাঠিয়ে দেবে। লোক জানাজানি হবে, হয়রানির শেষ থাকবে না। তাই বড় বাবুর সহানুভূতি আদায় করার জন্য বললেন, "এ ছাড়া আমি একটু লেখালিখিও করি"।

-- "আচ্ছা ! তা কী লেখেন শুনি" ?

-- "গল্প, উপন্যাস, এইসব"।

-- "কী উপন্যাস ?"

-- "আপনি নাম শুনেছেন কি না জানি না,আমার একটা লেখা একটু নাম করেছে,'পথের পাঁচালী'।"

--- "এবার ঠাটিয়ে একটা চড় কষাব। অনেক সহ্য করেছি। 'পথের পাঁচালী' কার লেখা জানেন ?"

--- "আজ্ঞে, আমার লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন আপনাকে নাম বললাম তো যখন স্কুলে ফোন করলেন !"

 বড়বাবু অবাক দৃষ্টিতে মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। কী যেন পড়বার চেষ্টা করলেন। তারপর বিস্ময় তার কণ্ঠস্বরে।
--- "আপনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ?"

বলতে বলতে বড় বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরে এসে তথাকথিত "আসামীর" পায়ের উপর গড় হয়ে পড়লেন তিনি। মাথা ঠুকে ঠুকে প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, "যান, মুতুন, মুতুন, এই থানার যেখানে খুশি মুতুন, যত খুশি মুতুন, পূণ্যভূমি হয়ে উঠবে এ থানা ।"

 এই পর্যন্ত বলে পঞ্চাননবাবু বললেন তারাদাসবাবুকে,"বুঝলে , সত্যি সত্যিই তোমার বাবাকে পুলিশে ধরেছিল"।

তারাদাসবাবু বললেন, "এ আপনার বানানো গল্প। আপনি লেখক মানুষ, সামান্য একটু কিছু কারো কাছে শুনেছেন হয়তো, তাই দিয়ে এত সুন্দর একটা গল্প বানিয়ে ফেললেন"।

--- গল্প হবে কেন ? আর, অন্যের মুখ থেকেই বা শুনতে হবে কেন ? সেদিনের সেই বড়বাবুটা যে আমিই। আমিই সেই পঞ্চানন ঘোষাল যিনি পুণ্য অর্জন করেছিলাম।।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts