আমার এক মাস্টারমশাই কোনদিন কারুর গায়ে হাত তুলতেন না। সেই তিনিই একবার মেজাজ হারিয়ে একজন ছাত্রকে চড় মেরে ফেলেছিলেন। ইস্কুল ছুটির পর নিজে সেই ছাত্রকে নিয়ে গিয়ে দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাইয়েছিলেন।
মনে পড়ছে আরও একজনের কথা। বাড়িতে সবসময় কয়েকটা বাড়তি ছাতা রাখতেন। বৃষ্টির দিনে টিউশন পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের জনে জনে জিজ্ঞাসা করতেন ছাতা আছে কিনা; না থাকলে দিয়ে বলতেন “জানি তোদের বৃষ্টিতে ভিজতে ভাল লাগে, কিন্তু এই সময়টা ভাল না। ভিজিস না। ছাতাটা নিয়ে যা। সামনের দিন নিয়ে আসিস।“
মফঃস্বলের এক অতি প্রবীণ মাস্টারমশাইকে তাঁর রোগশয্যায় ‘কি করতে ইচ্ছে করছে’ জিগ্যেস করায় প্রিয় ছাত্রের নাম করে বলেছিলেন, ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
ইস্কুলের সাথে বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া ছাত্রীর মাথার কাছে বসে রাত জেগেছিলেন যে স্যার কিম্বা ইস্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে চোট পাওয়া ছাত্রকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ে ছিলেন যে মাস্টারমশাই, তাঁদের তখন আলাদা আলাদা নাম ছিল হয়ত --- #সমর #বাবু #অমিত #স্যার #শিশির #বাবু #অমিয় #স্যার #ডিডি #স্যার #ডিএম #স্যার প্রমুখ, কিন্তু আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে মনে হয় তাঁদের একটাই পরিচয় ছিল – ‘শিক্ষক’ । তাঁরা বাংলা-ইতিহাস-ভূগোল-অঙ্ক-বিজ্ঞানের বাইরেও কি যেন একটা শিখিয়েছিলেন, সিলেবাসে যার হদিশ মেলেনি কোনদিন।
বিশ্বাস করুন, সিলেবাসের মধ্যে আর সিলেবাসের বাইরের অনেক অনেক জিনিস শেখানোর ফাঁকে এক মুহূর্তের জন্যেও বুঝতে দেননি এটা তাঁদের জীবিকা।
ছাত্রের কাছে হেরে গিয়ে যে শিক্ষক আনন্দে কেঁদে ফেলেন, কিম্বা ছাত্রকে শাস্তি দিয়ে যে শিক্ষক নিজেই কষ্ট পান, শিক্ষকতা শুধুই তাঁর জীবিকা হতে পারেনা।
এত বছরে সিলেবাসের মধ্যের আর সিলেবাসের বাইরের যা কিছু শিখেছি যতজনের কাছ থেকে, তাঁদের সকলকে আমার আনত প্রণাম। যা কিছু শিখতে পারিনি তার দায় পুরোটাই আমার। তার জন্য যা শাস্তি প্রাপ্য, মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। শুধু একটাই অনুরোধ ---- বহুদিন আগে যে ছাতাটা দিয়েছিলেন সেটা ফেরত দিতে বলবেন না। আপনাদের দেওয়া ওই ছাতাটার আজও বড্ড দরকার – সময়ে এবং অসময়ে। শুধু ওই ছাতার আশ্রয় পেতেই সারাজীবন আপনাদের ছাত্র হয়ে থাকব।
ভালো থাকবেন স্যার সুস্থ থাকবেন সবাই।
No comments:
Post a Comment