শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন রবিনবাবু। রবীন্দ্রনাথ বাগুই... সংস্কৃতের মাস্টারমশাই। আর দেড়বছর আছে চাকরি শেষ হতে। অষ্টম শ্রেণীতে যৎপরোনাস্তি জ্ঞান ও অম্ল-মধুর বাক্য বিতরণের পর ফিরছিলেন স্টাফরুমে।
প্রধানশিক্ষকমশাই-এর ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতেই এই তীব্র বাক্যবাণ তাঁর 'কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল'।
এ কি ভাষা ! বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে এ ভাষা ঢোকার অধিকার পায় কি করে !? চটি সংস্কৃত পাঠ্য বইটি বগলদাবা করে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়ালেন তিনি।
"পায়ে দড়ি বেঁধে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেবো!!!"....
আবার ! প্রায় ভিরমি খেলেন রবিনবাবু!!!
একটু এগিয়ে মাথাটা গলিয়ে দিলেন হেডমাস্টারমশায়ের ঘরের দরজা দিয়ে। দরজা থেকে ঘরের পুরোটা দেখা না গেলেও দেখলেন একটি মুস্কো লুঙ্গিপরা লোক দাঁড়িয়ে আছে হেডমাস্টারমশায়ের টেবিলের সামনে।
হেডস্যার গৌরবাবু অবশ্য বসেই আছেন।
'সর্বনাশ... কোনো গুন্ডা নাকি ! তাহলে কি অন্য স্টাফদের ডাকতে হবে এবার' ?
'আর করবি এরকম?', হুঙ্কার দিয়ে উঠলো লুঙ্গিধারী।
জিভ কাটলেন রবিনবাবু। এইভাবে তুই-তোকারি করে কে গালিগালাজ করছে হেডমাস্টারমশায়কে !!!
সঙ্গে সঙ্গে একটা মিনমিনে গলা কানে এলো : 'আর হবে না।'
'ওঃ হো, তাহলে কোনো ছাত্র আছে ভেতরে ! সে-ই তাহলে এমন সুমধুর বাক্যবিন্যাসের লক্ষ্যকেন্দ্র !', মনে মনে একথা ভাবতে ভাবতে ঘরের মধ্যে আরেকটু এগিয়ে গেলেন রবিনবাবু। এবার তাঁর দৃষ্টির গোচরে এলো একাদশ শ্রেণীর ছাত্রটি।
একইসঙ্গে তিনিও চলে এলেন হেডস্যারের দৃষ্টির গোচরে। হেডস্যার গোঁফ নাচিয়ে মুচকি হেসে কাছে ডাকলেন রবিনবাবুকে।
'মেরে তক্তা বানিয়ে দেবো, শয়তান।' রবিনবাবুর কানের কাছে হাঁক পাড়লো মিস্টার লুঙ্গি !
এবার মুখ খুললেন আদ্যন্ত বাঙাল হেডমাস্টারমশায়, 'এই ছোকরা কি লিখসে জানেন ?'
রবিনবাবু ভেটকি মাছের মতো মুখভঙ্গি করে মাথা নাড়েন।
'আমি তো ওদের বাংলা পড়াই', চেয়ারে ভালো করে হেলান দিয়ে বসে শুরু করেন হেডমাস্টারমশায় - 'তা ক্লাসে লিখতে দিসিলাম আমাগো বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী সম্পর্কে। এই
ছোকরা যা লিখসে তা দেইখ্যা আমার মনে হইল লিখাডা তার বাপকে দেখানো উচিত হইব।
রবিনবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে চশমার উপর দিয়ে তাকালেন সেই লুঙ্গিধারীর দিকে। তখন লোকটি লুঙ্গির ঢিলে হয়ে যাওয়া গিঁট খুলে আবার বাঁধছে। তাঁর সামনেই!
হেডমাস্টার বললেন,"ইনি লিখাটা পড়সেন। পইড়া যা বলার নিজের পোলাকে বলসেন। ইতে আমাগো কুনো হাত নাই। উনি নিজের পোলাকে পুরস্কার দিবেন কি তিরস্কার করবেন সিডা উনার ব্যাপার।"
রবিনবাবু অসহায়ের মতো উপর-নিচে মাথা নেড়ে বলেন,
"কি লিখেছে?"
"আপনি সজ্জন মানুষ", বললেন হেডস্যার, "বিদ্বানও বটে। নিজেই পড়েন লিখাডা...।" বলে একটি খাতা খোলা অবস্থায় এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে।
"অভিভাবকটিকে বললেন হেডমাস্টারমশাই,
"সবসময় বাবা-বাছা কইরা যে সন্তানকে মানুষ করা উচিত নয়, তা আপনি জানেন দেখতাসি। না জাইনলে তার পরিণাম বালো হয় না, আশা করি মনে রাইখবেন।"
পিতা-পুত্র প্রস্থান করলে টেবিলে কনুইদুটো রেখে হেডমাস্টার বললেন, "পড়েন লিখাডা। তবে মনে মনে। পইড়া যদি আপনি মূর্চ্ছা যাইতে চান তাইলে তা অত্যন্ত সংগত বইলাই আমি বিবেচনা করুম।"
খোলা পাতায় ওপরের দিকে শিরোনাম -
_'আমাদের বিদ্যালয়ের রবীন্দ্র-জয়ন্তী'_
তারপর লেখা,
'আমাদের বিদ্যালয়টি অনেক বড়। এখানকার একজন শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বাগুই। তিনি খুব ভালো শিক্ষক। উনি যখন ছোটো ছিলেন, মানে যখন ইস্কুলে পড়তেন তখন একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন।
একদিন তিনি একটি চিঠি মেয়েটিকে দিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল -
_'আমি যাই সাইকেলে, তুমি যাও হেঁটে,_
_তোমার-আমার দেখা হবে ইস্কুলের গেটে।'_
মেয়েটিও একটি চিঠি দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল,
_'রাস্তায় কুকুর আর আকাশে বাদুড়,_
_তোমার হাতেই পরবো আমি মাথায় সিঁদুর'।_
কিন্তু ওনাদের আর বিয়ে হয়নি।
সেই মেয়েটি বড় হয়ে আমাদের ম্যাডাম হয়েছেন। তাঁর নাম জয়ন্তী সেন। এই রবীন-স্যার আর জয়ন্তী-ম্যাম খুব ভালো মানুষ।
এই হলো আমাদের বিদ্যালয়ের *রবীন্দ্র-জয়ন্তী।"*
অনেক দূর থেকে যেন হেডমাস্টারের গলা ভেসে এল-
"আমি কিন্তু কইসিলাম, এমনটা অইতেই পারে।
হেই রামধন, রবিনবাবুর মুখেসোখে এট্টু জল ছিটাইয়া দে বাবা।"
😂😂😂😂😂