সময়টা প্রায় পঁচিশ বছর আগের...আমি তখন চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে কেমোথেরাপি তে কাজ করি...কিছু রোগী কে আমাদের আউটডোর বেসিস এ কেমো দিতে হত...একদিন তাদের মধ্যেই দেখলাম এক মাতৃস্বরূপা ভদ্রমহিলা কে ...নাম- লতিকা চক্রবর্তী...ওনাকে কেমো করার সময় দেখি একপাল লোকজন নিয়ে এগিয়ে এল এক উদ্দাম বোহেমিয়ান টাইপ দাড়িওয়ালা মানুষ ..." ডাক্তারবাবু , উনি আমার মা । মা আমার সবকিছু । মা'কে কেমো দেবার সময় আপনি আমাকে একটু পাশে থাকতে দেবেন ?..আসলে মায়ের খুব কষ্ট হয় এই কেমো নেবার সময় । আমি আপনাকে কোনরকম ডিস্টার্ব করবনা ..
শুধু মায়ের একটা হাত ধরে থাকব আমি ।"
সেই বলাটার মধ্যেই কিছু একটা ছিল । আমি আর না করতে পারিনি । পরম মমতায় সে জড়িয়ে রইল মা'কে । আদরে ভালবাসায় আর্দ্র তার গলা - " এই তো মা ..আমি আছি...এই তো হয়ে এসেছে ..কোন কষ্ট নেই..দেখো ডাক্তারবাবু কি সুন্দর ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন...না না আর ব্যথা লাগবেনা " । কেমো শেষ হল । ডাক্তারবাবুর চোখে তখন জল ।
সেই প্রথম আলাপ হল মানুষটির সঙ্গে । নাম জিজ্ঞাসা করলাম । পাশ থেকে কেউ একজন বলল " ওর নাম নচিকেতা চক্রবর্তী । গান গায় । এবার পুজোয় ওর একটা ক্যাসেট বেরিয়েছে কিছুদিন আগে । এই বেশ ভাল আছি - ক্যাসেট টার নাম" ।
বাড়ি ফিরে ক্যাসেট টা শুনলাম । কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি । এই কন্ঠ!! এই গায়কী !! এই বলিষ্ঠ শব্দচয়ন !! এ গায়ক তো সাধারণ নয় । রীতিমতো শিক্ষিত চর্চিত শিল্পী ।
সেই দিন থেকেই উনি আমার নচি'দা হয়ে উঠলেন আর আমি কখনও পার্থ কখনও ডাক্তার।
কয়েক মাস পর চলে গেলেন মাসিমা । দেখা হল নচিদার সঙ্গে ।...." পার্থ , বুঝলি মা কে সঙ্গে নিয়েই সব জায়গায় যাই এখন, আগে বাড়িতে রেখে এদিক ওদিক যেতে হত, অসুস্থ থাকত , আমার দুশ্চিন্তা হত । এখন মা সবসময় আমার সঙ্গে থাকে রে ...শোন মা কে নিয়ে একটা গান করেছি " .......মাখনের মত মোলায়েম কন্ঠ গেয়ে উঠল - " একা একা পথ চলা / একা একা কথা বলা " ...আবার ভিজল ডাক্তারের চোখ ।
বেশ কয়েক বছর পর একদিন গেছি নচিদার নতুন ফ্ল্যাট এ । বেশ বড় আর সুন্দর আধুনিক ফ্ল্যাট । আড্ডা চলছে । গান হচ্ছে । হঠাৎ চোখে পড়ল হলঘরের আধুনিক আসবাব সোফা টোফার মাঝখানে বেশ বেমানান একটা পুরোন দিনের সাদাকালো টিভি । পিছনে লাগলাম একটু ...." নচিদা, তোমার এত পয়সা !!! একটা কালার টিভি কেনোনি ?"
হাসল খানিকটা । তারপর বলল ..." পার্থ এই টিভি টা আমার মা কিনেছিল রে , কষ্ট করে , ইনস্টলমেন্টে .....আমি এই টিভি টাই দেখি , খারাপ হলে সারাই করে নিই , কিন্তু এটা আমি ফেলতে পারিনি রে "
গলার কাছে একটা কষ্ট আটকে রইল আমার। বাসে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম - হ্যাঁ এই মানুষটা, খালি এই মানুষ টাই পারে " বৃদ্ধাশ্রম" এর মত একটা গান লিখতে ...একমাত্র এরই ক্ষমতা , এরই অধিকার ওই গানে....মা'কে ওই অতটা না ভালবাসলে ওই লেখা কলম দিয়ে বেরোয় না , বেরোতে পারেনা । গানটার শেষ ছত্রে তাই উগরে দিয়েছেন সমগ্র বিশ্বাসঘাতক অপদার্থ সন্তান দের প্রতি রাগ, বিদ্বেষ আর প্রতিশোধস্পৃহা - " আশ্রমের এই ঘরটা ছোট , জায়গা অনেক বেশি / খোকা আমি দুজনেতে থাকব পাশাপাশি / সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম/ মুখোমুখি আমি, খোকা, আর বৃদ্ধাশ্রম "
( এটি একটি সংগৃহীত পোষ্ট ,লেখকের নাম জানি না .)
Monday, 18 March 2019
নচি'দা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
একদা কোন এক সময়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাধ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কবি সামসুর রহমান বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন । আড্ডা দেওয়ার এক পর্...
No comments:
Post a Comment