এক ICSE স্কুলের শিক্ষক হওয়ার কারণে ICSE আর ISC পরীক্ষার দিনগুলোতে আমাদের অনেককেই যেতে হয় অন্য স্কুলে Invigilation duty করতে, সোজা কথায় গার্ড দিতে! তো এবারে পালা করে এক-একটা স্কুলে ডিউটি দিচ্ছি, হঠাৎ একদিন সাতসকালে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমায় ডেকে বললেন – “তোমার Schedule টা একটু পাল্টালাম! তোমাকে একটা অন্য স্কুলে ডিউটি দিচ্ছি, একজন স্পেশাল চাইল্ড পরীক্ষা দিচ্ছে, তার জন্য একজন Invigilator দরকার। রোজ কিন্তু তোমাকে ওখানেই ডিউটি দিতে হবে। অসুবিধা নেই তো?” এসব ক্ষেত্রে অসুবিধা থাকলেও তা বলতে নেই। সুতরাং আমাকে ডিউটি লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হ’ল।
নির্দিষ্ট সময়ে সেই স্কুলে পৌঁছেও গেলাম, দেখলাম – আমার বসার জায়গা, বলা ভালো আমার ডিউটির জায়গা করা হয়েছে স্কুলের Accounts বা Fees collection-এর ঘরটিতে। আমার বসার জন্য একখানা চেয়ার ছাড়া আর একটা মাত্র টেবিল ও চেয়ার পাতা। তাতে একজনই মাত্র ছাত্র বসে। পরীক্ষার পেপার তখনও আসেনি। দেখলাম ও বসে-বসে পায়ের পাতা দিয়ে টেবিলের নীচে মেঝেতে তাল ঠুকছে, আর একই ভাবে হাত দিয়ে তাল দিচ্ছে টেবিলের ওপরে। প্রথম দেখায় যদিও ওর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারলাম। আমার সঙ্গে যা কথা হল তা খানিক এই রকম-
Student : Good afternoon sir.
Me : Very good afternoon. Myself Pallab Banerjee, What’s your name?
Student : I am Avinash.
Me : OK. Best of luck for your exam. If you don’t mind may I ask you a question?
Avinash : Yah! Why not?
Me : What type of physical problem do you have?
Avinash : I have a critical problem in my nervous system, for which I can move only a few muscles of my body.
ও অবিনাশ, অবাঙালী উচ্চারণে আভিনাশ! পরীক্ষা শুরু হল। হিসাব মত Council ওকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিরিক্ত সময় দেয়, ও কিন্তু প্রথম দু-দিনে তার একটুও ব্যবহার করেনি। দ্রুত লিখেছে, সময়ে শেষ করেছে। প্রথম দু-দিনে আমিও বার-বার ওকে দেখেছি আর ভেবেছি – “কই, তেমন কিছু তো সমস্যা মনে হচ্ছে না!” তিন নম্বর পরীক্ষার দিন আকাশ মেঘলা দেখে যথারীতি আমি একটু আগেই পৌঁছে গেছি সেই স্কুলে। Cash Collection-এর ঘরে গিয়ে দেখি তখনও আসেনি অবিনাশ। খানিক পরেই আমার চোখের সামনে স্কুলের Car Parking-এ একটা সাদা গাড়ি এসে থামল। গাড়ির ভিতর থেকে প্রথমে বেরিয়ে এল একটা Wheel Chair, এই Wheel Chair আমি চিনি। আমাদের room এর বাইরেই রাখা থাকে, এ জিনিস অবিনাশের। পিছনেই এক ভদ্রলোক নেমে এলেন, সম্ভবত ওর বাবা। অন্য গেট থেকে প্রথমে উনি টেনে বার করলেন এক জোড়া জুতো ও প্যান্ট-পরা-পা।এই পা’ও আমি চিনি- অবিনাশের। তারপর উনি সামনে থেকে টেনে আর ভিতর থেকে ওর মা ঠেলে বের করে আনলেন অবিনাশের গোটা শরীরটা। হুইল চেয়ারে ওকে বসিয়ে ওর মা হাঁপাতে-হাঁপাতে আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন। মনে হ'ল, এক প্রস্থ যুদ্ধ শেষ করে উঠলেন যেন। এরপর আসল চমক বাকি ছিল যেন আমার জন্য! অবিনাশের লড়াইয়ের প্রধান দৃশ্য – যা গত দু-দিনে আমার নজরে পড়েনি। হুইল চেয়ার গিয়ে ঢুকল পরীক্ষার ঘরে। সেখানে ওকে Transfer করা হ'ল সাধারণ চেয়ারে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি – ওর পা দুটো ছিল টেবিলের Foot-Rest-এ অর্থাৎ যে সরু কাঠটির ওপর আমরা পা রাখি, তার ঠিক ওপাশে। ও একবার মৃদুস্বরে ওর মা-কে ডেকে চোখের ইশারা করতে, মা ওর পা দুটো ধরে এপাশে করে দিলেন। Admit Card, পেন সব টেবিলে সাজিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আর একবার হেসে যখন ওর মা বেরিয়ে যাবেন ব'লে পা বাড়াচ্ছেন, ঠিক তখনই অবিনাশ ডেকে উঠল – “মাম্মি, মাম্মি! মেরে হাত...!” ওর মা ছোট করে “ও, হাঁ, ভুল গ্যয়ি থি” ব'লে এগিয়ে গিয়ে ওর দুপাশে ঝুলে-থাকা হাত দুটো ধরে, টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলেন এমন ভাবে যেন হাতে পেপার পেলেই সে লিখতে শুরু করতে পারে। এবার অবিনাশ হালকা ক'রে টেবিলের ওপর হাত দিয়ে আর নীচে পা দিয়ে তাল ঠুকতে শুরু করল, ঠিক যেমন দেখেছিলাম ওকে প্রথম দিন। ওর মা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমার গলার কাছটায় একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে আটকেই রইল। এই ছেলেটিকে এখন দেখে কে বলবে যে, নিজের পায়ের পাতা ছয় ইঞ্চি নাড়াবার সামর্থ্য ওর নেই? কে বুঝতে পারবে যে, নিজের হাত টেবিলের ওপরে তোলার দরকার পড়লে ওকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়? গত দু-দিন এই স্কুলের প্রিন্সিপাল, ওর আগের স্কুলের প্রিন্সিপাল এসে ওকে দেখে গেছেন একাধিক বার। আমার সঙ্গে দেখা ক'রে প্রত্যেকেই বলেছেন- “He is our topper, but see, how unfortunate he is..!”
অবিনাশ-অবিনশ্বর-বিনাশ নেই যার!অবিনাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভেবে চলেছি নিজের কথা, নিজেদের প্রতি একরাশ লজ্জা এসে গ্রাস করছে আমায়। কত সহজে আমরা কত-কত অভিযোগ করি আমাদের জীবনের বিরুদ্ধে, কত অল্পেই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ি যখন দেখি নিজেদের প্রাপ্তির খাতায় এক-চুল কম পড়েছে, ধৈর্য্য জিনিসটা-কে অনায়াসেই আমরা এড়িয়ে যাই, কত সামান্য কারণে আমরা কেঁদে ভাসাই। চোখের সামনে ছেলেটি বসে অনর্গল লিখে চলেছে আর আমার মনের ভিতরে চলে কেবল কিছু অনির্ণেয় প্রশ্ন:
আচ্ছা, আমাকে মশা কামড়াচ্ছে,
আমি হাত দিয়ে মশা তাড়াচ্ছি। ওকেও নিশ্চয় কামড়াচ্ছে, ও কী করবে?
আমার জল তেষ্টা পাচ্ছে, আমি বোতল থেকে জল খাচ্ছি, কিন্তু এই চার-ঘণ্টা ধরে যে ও পরীক্ষা দিচ্ছে ওর একদিনও তেষ্টা পায়নি? পেলে ও কী করবে?
বাড়ি ফিরে অবিনাশের কথা ভুলতে পারলাম না। ঘুম থেকে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ করতে-করতে এমন অনেক কাজ মাথায় আসতে লাগল আর আমি কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলাম না যে, সেই কাজগুলো অবিনাশ সামলায় কী ক'রে? আর যত ভাবতে লাগলাম ততই দিশাহারা ভাব জেগে উঠল মনে। তার পর থেকে একটা দিনের জন্যও ছেলেটার দিক থেকে চোখ সরাইনি, যদি কিছু দরকার হয় ওর, যদি আমার কাছে বলতে লজ্জা হয় – আমাকে তো দেখেই বুঝতে হবে ওর কী দরকার।
পরীক্ষা শেষের দিন আমায় বলল অবিনাশ – “Sir, you are a very nice person. I shall remember you” আমার গলা ধরে এসেছিল সেদিন, আমি বললাম – “I must say Avinash, I shall not just remember you, I shall respect you, rather I shall worship you” আসার আগে ওর মা-কে বলেছিলাম – “ও যদি আমার থেকে বয়েসে ছোট না হ’ত আর এটা যদি স্কুল ক্যাম্পাস না হ’ত তাহলে এখানেই আমি ওর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম”।
বিশ্বকর্মা জগন্নাথ গড়ার সময় কেন তার হাত-পা গড়েননি তা আমরা অল্পবিস্তর অনেকেই জানি, কিন্তু এটা সত্যিই জানিনা এত শক্তিশালী এক মানুষ গড়ে বিশ্বকর্মা এই ভুল কী ক'রে করলেন। সব দিলেন অথচ শক্তি দিলেন না!
ধন্যবাদ আমার ভাগ্যকে, ধন্যবাদ আমার স্কুল কর্তৃপক্ষকে, ধন্যবাদ আমার ঈশ্বরকে – তারা আমায় চোখের সামনে জগন্নাথ দর্শনের সুযোগ করে দিয়েছেন। লাখে-লাখে মানুষ সারা বছর ধরে পুরী যায় যে মূর্তিরূপী জগন্নাথ দেখতে, আমার সৌভাগ্য সেই জগন্নাথ আমার চোখের সামনে চলে-ফিরে বেড়িয়েছেন, আমার সঙ্গে কথা বলেছেন।
মাস তিনেক পর – পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমিও কোনো এক দরকারে সেই স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ নজরে পড়ল স্কুলের বাইরে গেটের কাছে ইয়া বড় একটা ফ্লেক্স টাঙানো – তাতে অবিনাশের ছবি। এবারেও সে ওই স্কুলের Topper. নিজের অজান্তেই আমার হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে উঠে গেল।
[ওপরের ঘটনাটিতে একটুও গল্প বা বানানো অংশ নেই। শুধুমাত্র ছাত্রের নামটা ইচ্ছে করেই বদলে দেওয়া হয়েছে]
সৌজন্যে - পল্লব ব্যানার্জী
No comments:
Post a Comment